ভারত একটি বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় দেশ যা ভারতীয় উপমহাদেশ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই উপমহাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতি কখনও কখনও দেশের ভৌত বিস্তৃতি ও রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। একই কারণে কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এর মধ্যে একটি হলো সংকীর্ণ উপত্যকা যা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে পশ্চিমবঙ্গ এবং এর বাইরের রাজ্যগুলির সাথে সংযুক্ত করে। এই অঞ্চল কখনও কখনও ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ নামে উল্লেখ করা হয়। এটি কেবল ভারতের দুটি অংশের মধ্যে একটি সংযোগ নয়। এটি একটি ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক বাঁক যা নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এবং চীন সীমানাকে কেন্দ্র করে রয়েছে। এটি একটি করিডোর যা মূলত মিয়ানমারের মাধ্যমে ভারতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে। এর সামরিক তাৎপর্যও সুপরিচিত। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার কারণে এর ভেদ্যতাকে ‘মুরগির ঘাড় (চিকেনস নেক) হিসাবে বর্ণনা করেছে। এটি দেশের একটি ব্যাপকভাবে সুরক্ষিত অংশ।
এটি ভারতের একমাত্র অংশ যা শারীরিকভাবে চারটি ভিন্ন দেশের সাথে যুক্ত। এই আন্তর্জাতিক সীমানা, এবং সংযোগ এই অঞ্চলের জনগণের জন্য একটি সুযোগও তৈরি করে। ভূরাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে, এখানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিবেশী প্রথম (নেইবারহুড ফার্স্ট) এবং অ্যাক্ট ইস্ট নীতির স্বার্থ জড়িত। এটি বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) এবং সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশনের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির সংগঠনকে সংযুক্ত করে। সুতরাং, এটি একটি অর্থে এখানেই ইন্দো-প্যাসিফিক শুরু হয়। দেশের এই অংশটিও উত্তর-পূর্বাঞ্চল রূপান্তরে প্রধানমন্ত্রী মোদির ফোকাস থেকে উপকৃত হওয়ার এক অনন্য অবস্থানে রয়েছে। সেতু, সড়ক, রেলপথ, বিমান যোগাযোগ এবং জলপথের মতো অবকাঠামোগত উন্নতির ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টার ফলাফল স্পষ্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, চিকিৎসা সুবিধার বৃদ্ধিতে এটা দৃশ্যমান। অঞ্চলটি এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সংমিশ্রণের সুযোগ কাজে লাগনোর অবস্থানে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শিলিগুড়ি ভারতীয় জাতীয় মহাসড়ক কর্তৃপক্ষের ‘গোল্ডেন চতুর্ভুজ’ এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এবং ভবিষ্যতের বিমসটেক ল্যান্ড কানেক্টিভিটি উদ্যোগের সাথে সংযুক্ত হবে। শিলিগুড়ি-বাগডোগরা অঞ্চলটিও একটি আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে। নেপাল এবং ভুটান সীমান্তের নিকটে এর কৌশলগত অবস্থান আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে। এর উর্বর সমভূমি একটি সমৃদ্ধ কৃষি খাত অনুমোদন করে। দক্ষ কারিগররা সমৃদ্ধ হস্তশিল্প শিল্পে অবদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্র জুড়ে প্রতিভা স্বাক্ষর রাখে। তদুপরি, এই অঞ্চলে তিস্তা নদী থেকে উল্লেখযোগ্য জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা এবং বাগডোগরা বিমানবন্দরের মাধ্যমে সংযোগ সুবিধা রয়েছে। সীমান্ত ও কাস্টমস অবকাঠামোর পাশাপাশি এই অঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে যা অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করেছে। শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত উচ্চগতির ডিজেল প্রবাহিত করার জন্য ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন। এটা যে এই অঞ্চলের বাহ্যিক সম্পদ এটি তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। ভারত ও বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সম্পর্কের আরও উন্নতি নিশ্চিত। এই সংযোগগুলি অনিবার্যভাবে শিলিগুড়ি এবং সংলগ্ন দার্জিলিংয়ের মধ্য দিয়ে বা তার কাছাকাছি দিয়ে যেতে হবে এবং এই অঞ্চলটি পরিবহন অর্থনীতির কেন্দ্র এবং ট্রান্স-শিপমেন্ট পয়েন্ট হিসাবে বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করবে। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত যে সংযোগ উন্নয়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি সরবরাহ করে। দার্জিলিং সবসময়ই শিক্ষার কেন্দ্র। এর স্কুল এবং কলেজগলো ভারত এবং এর আশেপাশের দেশগুলিতে দুর্দান্ত খ্যাতি রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শিক্ষাগত, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে।
ভারতের চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৮৭ থেকে বাড়িয়ে ৬৫৪ করেছেন। পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালীন কোভিড-১৯-এর সময় বিভিন্ন দেশে ভারতীয় ভ্যাকসিন, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য এবং চিকিৎসা সক্ষমতা পৌঁছে দিতে তার নেতৃত্বে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, ভারত থেকে বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানে চিকিৎসা সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা সক্ষমতা প্রায়শই একসাথে চলে এবং শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিংকে এই অঞ্চলের জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার একটি শক্তিশালী সম্ভাবনাও বিদ্যমান। এই প্রক্রিয়ায় ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বাগডোগরা বিমানবন্দরের আধুনিকীকরণের জন্য প্রকল্পটিতে অবদান রাখবে। একটি উন্নত বিমানবন্দরের অর্থ হলো দুয়ার এবং হিমালয়ের অন্যতম বৃহত্তম সম্পদ। এটা তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে পর্যটন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত এবং নতুন বিভাগে প্রসারিত করতে পারে। দার্জিলিংয়ে অনুষ্ঠিত জি-২০ অনুষ্ঠানগুলো ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্পে বিদ্যমান বিপুল সম্ভাবনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তদুপরি, শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক পর্যন্ত নর্থ ইস্ট গ্রিড প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের সমাপ্তির সাথে সাথে শিল্পায়নের উত্থান এই অঞ্চলকে নতুন রূপ দিতে চলেছে। এই অত্যাবশ্যকীয় ধমনী শক্তির একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের প্রতিশ্রুতি দেয়, কারখানাগুলিকে শক্তি দেয় এবং উন্নয়নের তরঙ্গকে প্রজ্বলিত করে।
সম্প্রতি ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরাম সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধিদলকে দার্জিলিংয়ে নিয়ে যায়। এতে ‘চা ও পর্যটন শিল্পের শক্তি’ এবং ‘কৃষি, অবকাঠামো এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে অনাবিষ্কৃত সুযোগ এবং অব্যবহৃত সম্ভাবনার আধিক্যের’ ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলও সুযোগ অনুসন্ধান, স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সাথে সহযোগিতা এবং এই অঞ্চলের চা বাগানের শ্রমিকদের সহায়তা করতে গত মাসে দার্জিলিং সফর করে।
এই হিমালয় এবং উপ-হিমালয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং শিক্ষার ওপর জোর প্রদান উচ্চমানের মানবসম্পদ তৈরি করে। মানব সম্পদ এবং অবস্থানের এই সংমিশ্রণটি একটি উপযুক্ত পরিবেশ, বিনিয়োগ এবং সুযোগের জন্য দৃষ্টির সাথে যখন যুক্ত হয়, তখন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরটিকে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধি করিডোরে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা থাকে। এই কৌশলগত করিডোরটি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা উচিত যাতে কেবল এটির বিকাশকে সর্বাধিক সম্ভাবনার সাথে নিশ্চিত করা যায় না বরং জাতির নিরাপত্তা স্বার্থও সুরক্ষিত থাকে। সময় এসেছে এর সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করার।
লেখক: হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং ভারতের জি-২০ প্রেসিডেন্সির প্রধান সমন্বয়ক
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল