আমার বাড়িতে খুশি নামে একটি মেয়ে কাজ করে। মেয়েটির জন্ম ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানার কাচিয়া গ্রামে। খুশি যখন কিশোরী, ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার খবর পেয়ে কট্টর মুসলমানেরা ভোলার হিন্দু গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল, খুশিদের কাচিয়া গ্রামও রক্ষা পায়নি। তারপরই রাতের অন্ধকারে খুশিরা চাষের জমি আর পোড়া ঘর বাড়ি পেছনে ফেলে চলে এসেছিল সীমান্ত পেরিয়ে, আশ্রয় নিয়েছিল নদীয়ায়। নদীয়াতেই শাড়ি বোনার কাজ করে সংসারের জন্য টাকা রোজগার করতে হতো খুশিকে।
পনেরো বছর বয়সে খুশির বিয়ে হয়ে যায়। তারপর অভাব এমনভাবে গায়ে চাবুক মারে যে স্বামী সন্তান সঙ্গে নিয়ে দিল্লিতে চলে আসতে বাধ্য হয় খুশি। শহরের পাঁচ বাড়িতে কাজ পেয়েছে। অভাব ঘুচেছে। হাসি-খুশি খুশি একদিন তার কাচিয়া গ্রাম ত্যাগ করার গল্প করলো আমাকে। বললো তার খুব যেতে ইচ্ছে করে তার গ্রামে। গ্রাম নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। সে অনেকের কাছে গল্প করে তার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গ্রামের, তার গ্রামের মতো সুন্দর গ্রাম পৃথিবীতে নাকি আর কোথাও নেই। সে খবর পেয়েছে তার গ্রামে গ্যাস পাওয়া গেছে। দিল্লির পড়শিদের বড় গলা করে শোনায়,‘তোমাদের গ্রামে কি গ্যাস পাওয়া গেছে, আমাদের গ্রামে গ্যাস পাওয়া গেছে।’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে খুশির চোখমুখ। ইন্টারনেটে আমি যেন তাকে তার গ্রামের ছবি দেখাই, আমাকে আবদার করেছে। ছবি দেখালে ১২ বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে চলে আসা চল্লিশোর্ধ্ব খুশির চোখে খুশির জল। বাড়িতে অন্য যে মেয়েরা কাজ করে, তাদের ডেকে ডেকে দেখালো তার গ্রামের ছবি। বললো তার খুব যেতে ইচ্ছে করে তার গ্রামটিতে। একদিন সে যাবেই। গিয়ে কখনও আর ফিরে আসবে না। ও দেশেই, তার বাপ ঠাকুরদার ভিটেতেই রয়ে যাবে। এই দেশে কিচ্ছু নেই, সব আছে ওই দেশে, তার দেশে। খুশি ভুলে গেছে ওদের কথা যারা তার গ্রামে আগুন ধরিয়েছিল। সে ভাবতে থাকে সে গ্রামের রাস্তায় মাথা উঁচু করে হাঁটছে, আর তার শৈশব কৈশোরের খেলার সাথীরা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরছে। সবাই টানাটানি করে তাকে তাদের বাড়িতে নিচ্ছে, সুস্বাদ্য সব মাছ মাংস রান্না করে খাওয়াচ্ছে। খুশির এই স্বপ্নটিকে আমি ভেঙে দিই না। ওর হয়তো আর তেমন কিছু নেই এই স্বপ্ন ছাড়া।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)